Home পৌরাণিক কাহিনী বলাগড় শ্রীপুরের রাসমেলা; শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণবের মিলনমেলা

বলাগড় শ্রীপুরের রাসমেলা; শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণবের মিলনমেলা

by banganews

দেবতনু দাস

মেড়ের প্রতিমা। ঠাকুরদালান। আশপাশে ছড়ানো মন্দির, রাসমঞ্চ। গথিক স্থাপত্যের ছোঁয়ায় জমিদারি ঠাটের মধ্যে ইতিহাস ও নস্টালজিয়ার সুঘ্রান। রয়েছে নোনা ধরা দেওয়াল, কড়ি বরগা আর ৩০৮ বছরের ইতিহাস। ঢাক-ঢোলের সঙ্গে খোল-খঞ্জনীর শব্দের অনুরণনে মিশে যাচ্ছে হরিনাম সংকীর্তন। বহুগোপী ও বহুকৃষ্ণের মধুর রসসিক্ত রাসের মাঝেই শক্তি ও শিবের বিয়ে। আসলে শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব মতে উপাসনার এ এক বাস্তবিক মেলবন্ধন। এদিকে আবার রয়েছে জমিদার ও প্রজার মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আর্থিক বিভেদ ভুলে আর্থ-সামাজিক সাম্যের বার্তা- আর এসব কারণেই হুগলির বলাগড়ের শ্রীপুর রাস উৎসব আর পাঁচটা রাস উৎসবের থেকে একেবারে আলাদা।

সালটা ১৭১৩খ্রীষ্টাব্দ বা ১১২০ বঙ্গাব্দ। শ্রীপুর গ্রামের তৎকালীন জমিদার রঘুনন্দন মুস্তাফী এই রাস উৎসবের প্রচলন করেন। রঘুনন্দন মুস্তাফী নিজে ছিলেন শৈব অর্থাৎ শিবের উপাসক। বাড়িতে শাক্ত কুলদেবী বিন্দুবাসীনি। শাক্ত বাড়িতে বৈষ্ণবের উৎসব শুরু হল বটে তবে তার ধরণ পাল্টে দিলেন রঘুনন্দনবাবু। রাস উৎসবের মাধ্যমে তিনি এমন কিছু প্রথার প্রচলন করলেন যা তৎকালীন যুগ অনুযায়ী ছিল বেশ আধুনিক। এই উৎসবের মাধ্যমেই শৈবউপাসক জমিদার চালু করলেন শিব ও শক্তির প্রতীকী বিয়ে। যে প্রথা আজও চলে আসছে।

সমাজের আর্থিক বৈষম্য দূর করতে তিনি করেছিলেন আরও একটি কাজ। বরসাজে শিব আসতেন কোনও প্রজার বাড়ি থেকে। অর্থাৎ শিব এখানে প্রজার ছেলে। আর কনে বিন্দুবাসিনী হল জমিদারের কন্যা। দৈবের মানবায়ন ঘটিয়ে এ এক মিলনের মেলা…… নিজে শৈব হয়ে কেন হঠাৎ বৈষ্ণবদের শ্রেষ্ঠ উৎসব রাসের প্রচলন করলেন জমিদার রঘুনন্দনবাবু? কেনই বা আর্থ-সামাজিক বিভেদ ঘুঁচিয়ে শাক্ত-শৈব ও বৈষ্ণবের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটনার চেষ্টা? নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ…

প্রথমত, জমিদারবাবু নিজে শিবের ভক্ত হলেও তাঁর স্ত্রী ছিলেন বৈষ্ণব। বাড়িতে রাস উৎসব শুরু করার নেপথ্যে যা ছিল প্রধান কারণ। অপরদিকে, সেই সময়টার দিকে যদি আমরা তাকায় তাহলে দেখব হিন্দু ধর্মের অন্দরে এক বিভেদের ইতিহাস। যদিও এই বিভেদ চৈতন্যদেব অর্থাৎ অবিভক্ত বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারকের আবির্ভাবের আগে থেকেই ছিল।

 

বহু প্রাচীনকাল থেকেই আমরা শুনে আসছি রাঢ়বঙ্গ হল শক্তি আরাধনার পীঠস্থান। তাই শাক্ত ও বৈষ্ণবের দ্বন্দ্ব বঙ্গের ধর্মীয় ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একসঙ্গে শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব প্রথাকে মিলিয়ে দিয়ে এই বিভেদ ঘোঁচাতে চেয়েছিলেন রঘুনন্দনবাবু। পাশাপাশি যে আর্থসামাজিক বিভেদ আমাদের সমাজের চিরকালীন ট্রাজেডি- প্রতীকী বিয়ের মাধ্যমে সমাজের সেই অচলায়তনের বিরুদ্ধে কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিলেন তিনি।

এইসব প্রথার পাশাপাশি এখন বাউল, যাত্রার মতো লোকসংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। করোনার কারণে যেসবে রাশ টানতে হয়েছে এবার। প্রায় ২০০ বছর হল জমিদারি উঠে গেছে। বিগত ১০০ বছর ধরে শ্রীপুর রাসউৎসব বারোয়ারি। কিন্তু, আজও রয়েছে সেইসব প্রথা। নস্টালজিয়ায় উকি দিয়ে সেসব আজও বেশ তাড়িয়ে উপভোগ করে বলাগড়বাসী।

You may also like

Leave a Reply!