গাহো জয় গাহো জয় গাহো বাংলার জয়/দেহে নাহি ক্লান্তি, বুকে নাহি ভয়…যিনি লিখেছিলেন, তাঁর এই ছন্দটা শুধু কবিতার খাতিরেই ছিল না। ভয় আর ক্লান্তি যে কী জিনিস, তা জানতেনই না গুরুসদয় দত্ত।
এই নিঃশঙ্ক দৃঢ়তার ওপর ভিত্তি করেই বাংলার ব্রতচারী আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছিলেন মানুষটি। শারীরিক শক্তির সঙ্গে শিল্প সংস্কৃতি এবং অধ্যাত্ম ভাবনার মেলবন্ধনে যে ব্রতচারী দল ব্রিটিশ ভারতের যুগে বাংলার পরম সম্পদ হয়ে উঠেছিল, তার দিশারী মানুষটি চলেই গেলেন বার্ধক্য ছোঁয়ার আগে। মাত্র ৫৯ বছর বয়সে আজকের দিনেই (১৯৪১ সাল)। যৌবনের সঙ্গেই যাঁর নিয়ত ওঠাবসা, তিনি আর বৃদ্ধ হবেন কী করে!
জীবৎকালের মধ্যে দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি গুরুসদয়। পরাধীন ভারতের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী পেশাতেই রয়ে গেলেন অগত্যা। তবে দেশ কিন্তু তাঁর চাকরির কাছে , গবেষণার কাছে ঋণী। মানুষটি নিজেও তাই চেয়েছেন কিনা! পেশাসূত্রে সাহেবি হলেও নেশাসূত্রে তৃণমূল স্তরের অন্বেষণকারী। লোকসংস্কৃতি নিয়ে তাঁর আজীবনের গবেষণা, প্রেম, স্বপ্নের ফলশ্রুতি এই ব্রতচারী আন্দোলন। বলা বাহুল্য, গুরুসদয়ের খোঁজ বাংলা তথা ভারতের নিজস্ব শিকড়ের। পরজীবী সভ্যতা তাঁকে কখনওই টানেনি।
আরও পড়ুন ছোট্ট একটি মেয়ে তার ঘোড়ার জন্য গান গাইছে, দেখুন ভাইরাল এই ভিডিও
অধুনা বাংলাদেশের সিলেট জেলার বীরশ্রী গ্রামে তাঁর জন্ম হয় ১০ মে ১৮৮২ সালে। বাবা রামকৃষ্ণ দত্ত চৌধুরী ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার। তবে জমিদারি পদবি ‘চৌধুরী’র সঙ্গে কোনওদিনই একাসনে বসেননি গুরুসদয়। শুধু দত্তই তাঁর পরিচয়। যদিও মাত্র ৯ বছরে বাবা আর ১৪বছরে মা‘কে হারিয়ে ফেললেন, তবু তাঁর ঘনিষ্ঠতা বিলাসের সঙ্গে হল না, হল শিক্ষার সঙ্গে। এন্ট্রান্স এবং এফএ দুই পরীক্ষাতেই যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয়। টাকা দিতে না চাওয়া পারিবারিক বাধাকে তুড়িতে উড়িয়ে স্কলারশিপের অর্থে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাড়ি। শিক্ষাশেষে আইসিএস পরীক্ষার প্রথ ভাগে সপ্তম। দ্বিতীয় ভাগে প্রথম।
তবে না, তাঁর কর্মভূমি কিন্তু বিদেশ নয়, বাংলাকে আর বাংলাভাষাকে বেছে নিলেন গুরুসদয়।
পরাধীন ভারতের স্বাধীন চিন্তার এই মানুষটি শুধুই সংস্কৃতিপ্রবণ নন, সমাজসংস্কারকও। বিশেষ করে দমকলকর্মী এবং বন্যা দুর্গত মানুষদের জন্য একার উদ্যোগে তাঁর কাজ আজও দৃষ্টান্তস্বরূপ। গরিব গ্রামীণ সমাজ আর নারীজাতির জন্য গুরুসদয় দত্তের সংস্কারমূলক কাজ আলোড়ন ফেলল দেশে। পাশে পেলেন তাঁর স্ত্রী নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত সরোজনলিনীকে।
গ্রামসমাজকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে গিয়েই ব্রতচারী আন্দোলনের সূত্রপাত। প্রাচীন ও স্থানীয় লোকসংস্কৃতিকে নিয়ে এমন কার্যকরভাবে যে এক গণজাগরণ ঘটানো যায়, গুরুসদয়ের আগে আর কেউ তা দেখাতে পারেননি। ব্রতচারী আন্দোলন তথা লোকসংস্কৃতির ওপর আধারিত অসংখ্য বইয়ের সঙ্গে শিশুসাহিত্যেও তাঁর অবদান কম নয়।
আরও পড়ুন চা বিক্রেতার কন্যা আঁচল গাঙ্গওয়াল হলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর যোদ্ধা পাইলট
তবে অক্লান্ত পরিশ্রম শরীরে সইল না। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে পরেই শরীর ভাঙল। ধরা পড়ল ক্যান্সার। সেই মারণব্যাধিই নিভিয়ে দিল এক অনন্য কর্মপ্রদীপকে। থেকে গেল তাঁর আজীবনের সংগ্রহ, আগামী যুগের জন্য, তাঁরই নামাঙ্কিত সংগ্রহশালায়। আর রইল তাঁর দেখানো পথের ছায়া—গুরুসদয় দত্ত রোড নামে।