বাংলার পুরোনো ইতিহাসের এক খণ্ডচিত্র এই চণ্ডী মন্দির। এই চণ্ডী মন্দির গড়ে ওঠার পিছনেও ইতিহাস আছে।গঙ্গার শাখা নদী সরস্বতী তখন এখানে এক প্রবল স্রোতস্বিনী নদী ছিল।সরস্বতী নদীর সেই গতি প্রবাহ এখন আর নেই। সময় গ্রাস করেছে এক সময়ের এই প্রবাহকে, যার উপর দিয়ে নাকি সওদাগরদের সপ্তডিঙ্গা ভেসে যেত।
এমন কথাই প্রচলিত আছে, এমনই এক অতীতে সরস্বতী নদীর তীরের বেতবনের পাশ দিয়ে সপ্তডিঙ্গা ভাসিয়ে বাণিজ্যে চলেছিলেন শ্রীমন্ত সদাগর। রাত্রি হয়ে এসেছিল। বিশ্রামের জন্য জায়গা খুঁজছিলেন শ্রীমন্ত। তার সপ্তডিঙ্গা এখানে নোঙ্গর করা হলো। শ্রীমন্ত রাত্রে স্বপ্ন দেখলেন দেবী চণ্ডীর। দেবী স্বপ্নে জানালেন তিনি বেতবনে আটকে আছেন। শ্রীমন্ত তাঁর মূর্তি উদ্ধার করলেন।
দশফুট উঁচু পাথরে উপরের অংশে যেন মুখের আকৃতি। মন্দির তৈরী হলো তাঁর। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হলেন দেবী। পূজারী নিত্য পূজা করেন দেবীর। প্রতিদিন পূজার আগে দশফুট উঁচু দেবী মূর্তিস্বরূপ পাথরে মালা দেওয়া তার পক্ষে কষ্টকর হয়ে উঠছিল। পূজারী রোজই দুঃখ করতেন এই জন্য। একদিন সকালে দেবীকে মালা পরানোর সময় মূর্তি পাতাল প্রবেশ করতে থাকলো। পূজারী কেঁদে ক্ষমা চেয়ে মূর্তির বাকী অংশ জড়িয়ে ধরলেন। মূর্তির সেই মুখের অংশটুকু রয়ে গেল গর্ভগৃহে মাটির উপরে। সেই অংশটিই এখানে দেবী চণ্ডীস্বরূপা
অসুরবিহীন দেবী দুর্গার দুটি হাত
কালের গ্রাসে একদিন নষ্ট হলো সেই মন্দির। আবার নতুন মন্দির তৈরী হল।এখন থেকে ঠিক দুশো বছর আগে ১২২৮ বঙ্গাব্দের ৩১ শে আষাঢ় (১৮২১ খ্রীষ্টাব্দ) নতুন মন্দিরটি নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়ে উদ্বোধন হলো। মন্দিরটি তৈরী করিয়েছিলেন মহিয়ারী বা মৌরীর (মৌড়ী) জমিদার রাধাকান্ত কুণ্ডুচৌধুরী। পূজারী ছিলেন মহিয়ারীর রাজেন্দ্র লাল চট্টোপাধ্যায়। দেবীমূর্তির মাথায় মুকুট। জবা ফুলের মালার আড়ালে মুকুটের ছবি পুরোটা ধরা পড়ে না। মুখের আকৃতিতে কপালের নীচে সোনার ভ্রূ আর ত্রিনয়ন। সোনা দিয়ে তৈরী দুটি কানের আকৃতির গয়না মুখের দুপাশে। তার নীচে সোনার নাক ও ঠোঁটের আকৃতি।
ঠোঁটের সঙ্গে কেউ হয়তো একটি জিভের মতো অংশ দান করেছে। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে এই মকরচণ্ডীর উল্লেখ আছে বলা হয়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে এর উল্লেখ আছে। কোন কোন মতে এই অঞ্চলের নাম ছিল মাপুরদহ যা পরে মাকড়দহে পরিণত হয়। মাপুরদহ অর্থ মায়ের পুর বা নগর যে দহে। আবার এও কথিত আছে, সরস্বতী নদীতে এই অঞ্চলে এক সময় প্রচুর কুমীর বা মকর থাকতো। তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যে সওদাগররা এই মকরচণ্ডীর পূজা করতেন। তাই মাপুরদহ বা মকরচণ্ডী থেকে এই মন্দিরের নাম ক্রমে মাকড়চণ্ডী হয়ে উঠেছে।