TheBangaNews.com | Read Latest Bengali News | Bangla News | বাংলা খবর | Breaking News in Bangla from West Bengal

প্রশংসা থেকে সমালোচনা সব কিছুর পরে তিনি প্রসেনজিৎ তিনিই ইন্ডাস্ট্রি

তাঁকে নিয়ে অজস্র অভিযোগ আছে। কিন্তু তিনি ইন্ডাস্ট্রির প্রত্যেকের কথা ভাবেন। টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে স্পটবয় – সবার ভালোমন্দের উপর তাঁর খুঁটিনাটি নজর থাকে।  অটোগ্রাফ ‘ ছবির বিখ্যাত ডায়লগ ছিল- ‘ আমিই ইন্ডাস্ট্রি ‘। সেটা  যখন বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা শুরু হতে লাগল, এক টিভি শো-তে চিরঞ্জিত বলেছিলেন – আমি ছিলাম না? তাপস ছিল না? রঞ্জিতদা ছিলেন না? এমনকি প্রসেনজিতের নেটওয়ার্ক নাকি মারাত্মক! কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো নেগেটিভ কথা বলতেও নাকি সাহস পায় না।

বাংলা কিংবা ভারতীয় ছবির নিরিখে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের গোটা জার্নিটা দেখা যায়, সেটা প্রচন্ড অবাক করে। রীতিমতো ভাবায়!

তখন আটের দশক। একাশি কি বিরাশি! বলিউড  তখন মিঠুন আর বাপ্পি লাহিড়ীময়। বাপ্পি লাহিড়ীর দোরে দোরে ঘুরছেন বাংলার প্রোডিউসাররাও। ততদিনে  ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে একপ্রকার ভাসিয়ে দিয়ে মুম্বাইয়ে চলে গেছেন সুদর্শন অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায় পড়ে গেলেন অকুল দরিয়ায়! দমদমের অট্টালিকা থেকে বাধ্য হয়ে ছেলে বুম্বা  আর মেয়ে মাকুকে নিয়ে নেমে এলেন কসবা ব্রিজের নিচে কুঠুরির মতো এক কামরার একটা ঘরে।  টিভি বলে কোনো বস্তু ছিল না। স্নান-পায়খানার জায়গা পাশাপাশি। চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর। দমদমের প্রাসাদে থেকে, সুপারস্টারের পরিবার হিসেবে তখন সবাই বাবুয়ানাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন। তাই চূড়ান্ত কষ্টের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। পরে তপন সিংহর ‘ আতঙ্ক ‘ ছবিতে যখন বুম্বা কাজ করছেন,  তপনবাবুই একদিন পরামর্শ দিলেন দক্ষিণ কলকাতায় একটা আস্তানা তৈরি করে নিতে। বাসে করে আসতে আসতেই মুখচোখে স্ট্রেন হয়ে যাবে। অভিনয় হবে কীভাবে! সবাই চলে এলেন বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে।

 

পয়সা রোজগারের জন্য গোড়ায় পেশাদার মঞ্চে অভিনয় শুরু করেছিলেন বুম্বা। আয় হত পাঁচশো টাকা। তাঁর প্রথম কাজ সি এল টি-তে। নাটক ছিল টেনিদাকে নিয়ে – ‘ চারমূর্তির গোয়েন্দাগিরি। ‘ প্রযোজনা করিয়েছিলেন বুম্বার মা রত্নাদেবী। ক্যাবলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বুম্বা। আর টেনিদা হয়েছিলেন বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। পরিচালক ছিলেন কৌশিক সেনের বাবা শ্যামল সেন। শো একদিন শুরু হয় হয়, খবর এলো স্বয়ং সত্যজিৎ রায় শো দেখতে এসেছেন। তিনি নাটক দেখে বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়কে কাস্ট করলেন
‘ প্রতিদ্বন্দ্বী ‘তে।

সেই দলে অভিনয় করতেন কল্যাণী মন্ডল৷ একদিন বুম্বার সমস্যার কথা শুনে লোকজনকে বলে  তাঁদের বালিগঞ্জ গেস্ট হাউজের নিচের তলায় ভাড়া থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। স্যাঁতসেঁতে ঘরে থেকে স্ট্রাগলের সেই শুরু!
কয়েকদিন পরেই বুম্বার অ্যাজমার টান শুরু হ’ল। শরীরও মারাত্মক অসুস্থ হয়ে গেল। এক মাসি তাঁকে নিয়ে গেলেন জোর করে। বললেন – ঢের হয়েছে। আর হিরো হতে হবে না! জীবনে ফিল্মই একমাত্র লাইন নয়। তাঁর দাদামশাইয়ের তৈরি একটা বড় ইন্সটিটিউট ছিল। বুম্বাকে বোঝানো হ’ল একটা এয়ারো ইঞ্জিনিয়ারিং জাতীয় কিছু কোর্স করতে। কিন্তু বুম্বা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ – ফিল্ম ছাড়া অন্য কোনো লাইন তাঁকে দিয়ে হবে না।মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে বোনের বিয়ে দিতে হ’ল বাধ্য হয়ে। সবাই ভেবেছিলেন নিজের মেয়ের বিয়েতে অন্তত বাবা একবার আসবেন। এলেন না।

 

আবার বুম্বা ফিরলেন অনিশ্চয়তা আর স্ট্রাগলে ভরা জগতে। খাবার বলতে জুটত গলির পাইস হোটেলের ডাল-ভাত, পাশের ক্যান্টিনের খাবার কিংবা টিফিনবক্সে মায়ের দেওয়া খাবার . তখন আর্থিক অবস্থাও ছিল খুব খারাপ। দমদম থেকে টালিগঞ্জে পরিচালকদের মিট করতে যাওয়াটাও ছিল অসম্ভব ঝক্কির ব্যাপার। সেই দুর্দিনে বুম্বাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন দমদমের বাসিন্দা শ্যামবাবু বলে একজন। রত্না চট্টোপাধ্যায়কে নিজের দিদি মনে করতেন তিনি। শ্যামবাবু দমদম থেকে টালিগঞ্জে মোটরবাইকে করে বুম্বাকে নিয়ে যেতেন। তারপর শ্যুটিং স্পট কিংবা কোনো পরিচালকের কাছে ধর্না দেওয়ার থাকলে সেখানে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতেন নিজের অফিসে। তারপর নিজের অফিস থেকে ফেরার পর ছ’সাত ঘন্টা অপেক্ষা করে বুম্বাকে আবার নিয়ে যেতেন বাইকে করে। প্রতিষ্ঠিত কাউকে মিট করার সময় ভালো পোশাকের দরকার পড়ত। শ্যামবাবু নিজেই দোকানে বুম্বাকে নিয়ে গিয়ে বলতেন যে শার্ট টা পছন্দ হচ্ছে, কিনে নে। এখনও ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন শ্যামবাবু। বিনিময়ে কখনো কিচ্ছু চাননি।

 

একসময় উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কোলে চেপে বেড়ানো বুম্বাকে কোনো ডিরেক্টর কাজ দিতেন না। বড়জোর সহানুভূতি পাওয়া যেত। তবে বুম্বাকে দেখতে খুবই সুন্দর। একবার প্রিয়া সিনেমায় একটা অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর স্বনামধন্য এক ডিরেক্টরকে গাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে গেছিলেন বুম্বা৷ সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়া ‘ট্যাঁশ’ বুম্বা তখন ডেনিম পরতেন।
বুম্বার মা সেই পরিচালকের কাছে ছেলের জন্য রোল চাইতে গেলে সেই পরিচালক যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করে  বলেছিলেন ছেলেকে খাকি প্যান্ট আর বাংলা শার্ট পরিয়ে স্টুডিওতে আনবেন। তাতে ওর যদি কিছু হয়!

 

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পেলেন সাহিত্য একাডেমীর ফেলো সম্মান

বহুবছর পরে বুম্বা যখন বড় স্টার, সেই পরিচালকের ছবিতে কাজ করার সময় প্রোডিউসারের লম্বা টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস দেখে বুম্বা সটান বলেছিলেন কন্ট্রাক্ট করবেন তিনি নিজের টার্মসে। সেই পরিচালকের টার্মসে নয়।

অন্যদিকে আর এক নামকরা পরিচালক একসঙ্গে তাঁর সাতটা ছবি থেকে বুম্বাকে বাদ দিয়ে দেন। কয়েকটা তিনি পরিচালনা করেছিলেন, কয়েকটার স্ক্রিপ্ট রাইটার ছিলেন। তাঁর কিছু শর্ত বুম্বা না মানায় তিনি বুম্বাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তিনি দেখে নেবেন বুম্বা কীভাবে ইন্ডাস্ট্রিতে রাজ করেন!

একটা ছবিতে বুম্বা- দেবশ্রী- শতাব্দী কাজ করছিলেন। পরিচালক ছিলেন শ্রীকান্ত গুহঠাকুরতা। সেই পরিচালক বললেন বুম্বা কাজ করলে তিনি স্ক্রিপ্ট দেবেন না৷ কাজ মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে উৎপল দত্ত আর অনুপকুমারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।
বহু বছর পরে শিলিগুড়িতে বুম্বা একটা বাসের উপর বসে স্বপন সাহার একটা শ্যুটিং করছিলেন, সেই পরিচালক ফোন করে বললেন তাঁর  স্ক্রিপ্ট এ ‘ রামলক্ষ্মণ’ ছবিটা করার জন্য প্রোডিউসার তাঁকে একটাই শর্ত দিয়েছেন বুম্বাকে থাকতে হবে। বুম্বা বুঝলেন সেই পরিচালকের এখন শনির দশা। বুম্বার একটা ‘ হ্যাঁ’ ই তাঁকে বাঁচাতে পারে। ভদ্রলোককে তাজ্জব করে দিয়ে স্ক্রিপ্ট না শুনেই বুম্বা হ্যাঁ করে দিয়েছিলেন।