Home পাঁচমিশালি বিশ্বের প্রথম মহিলা মাহুত কুইন অফ এলিফ্যান্ট

বিশ্বের প্রথম মহিলা মাহুত কুইন অফ এলিফ্যান্ট

by banganews

অসমের গৌরীপুর রাজবাড়ীর রাজকন্যা ইনি। ছোটোবেলায় পুতুলের বিয়ে দিয়ে নয়, বরং হাতি বাঘ সহ বিভিন্ন হিংস্র পশুর শাবকদের সঙ্গে খেলেই বড় হয়েছেন তিনি। এই রাজকন্যার পোশাকি নাম হল পার্বতী বড়ুয়া, ওয়ার্ল্ড লাইফ ফোরামে যাকে সকলে চেনেন ‘কুইন অফ এলিফ্যান্ট’ নামে।

পার্বতী বড়ুয়ার জন্ম হয় ১৯৫৩ সালের ১৪ ই মার্চ শিলং এর রাজ পরিবারে। বাবা ছিলেন বিখ্যাত হস্তিবিশারদ প্রকৃতীশ বড়ুয়া (লালজী)। তাঁর জিম্মায় ছিল ৩৪১ টি বাঘ ও ১০০ টির বেশি চিতা। বাবার কাছেই ছোট থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন তিনি। আর বাবা যা শেখাতেন তা চট করেই আয়ত্তে আনতেন ছোট্ট পার্বতী।

আজ তিনি ৬৭ বছরের প্রৌঢ়া। ছিপছিপে চেহারার পার্বতী গত ৫০ দশক ধরে হাতিদের পরিচর্যা করে চলেছেন। হাতিকে বশে আনার কৌশল এখন তার হাতের মুঠোয় । অনেকেই এখন প্রশিক্ষণ নিতে চান তাঁর কাছে। অনেক সময় তিনি এই ভয়ঙ্কর কাজকে এড়িয়ে বারেবারে ফিরে যেতে চেয়েছেন বিলাসবহুল জীবনে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তার মন থিতু হয়নি, পুনরায় ফিরে এসেছেন জঙ্গলে। তার মতে, ‘ বন্য প্রাণী গুলোর পাশে না দাঁড়ালে ওরা বড়ো একা হয়ে যাবে।’ শুধু নিজেই না, আরও পাঁচটা মানুষকেও তিনি বোঝান, জঙ্গলের প্রাণী গুলি মানুষেরও বন্ধু। এদের একে অপরের সাহচর্য ছাড়া বাঁচা সম্ভব নয়।

পার্বতী বয়স যখন এক মাস সতেরো দিন তখন ছোট্ট পার্বতীকে শিলং থেকে গৌরীপুরের বাড়িতে আনা হচ্ছিল। পথে বিরতির জন্য গাড়ি থামে দামরায়। সেখানে চলছিল হাতি শিকারের ক্যাম্প। তখন থেকেই হাতি শিকারের প্রতি একটা যোগসূত্র তৈরি হয় তার। এরপর হাতির বাচ্চাদের নিয়ে খেলা শুরু তার, আস্তে আস্তে হাতির মাঝেই বড় হয়ে ওঠেন তিনি।

প্রতি বছর বিজয়া দশমীতে কুলদেবী মহামায়ার পুজো সেরে হাতি শিকারে বের হতেন লালজী। বাবার সঙ্গী হতেন পার্বতীও। জঙ্গলে ক্যাম্প হত। সেখানেই সকলে দল বেঁধে থাকতেন তারা, যাতে বাচ্ছাদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য সঙ্গে যেতেন একজন শিক্ষকও। একদিকে ‘মেলা শিকারের'(হাতি শিকার) প্রশিক্ষণ চলত, আর অন্যদিকে জারী থাকত পড়াশোনাও। এমন করেই গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন পার্বতী । পরে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এম. এ. তে ভর্তি হলেও শেষ হয়নি তা, অসমাপ্ত রেখেই ছুটে গিয়েছেন জঙ্গলে।

১৯৬৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই পার্বতী প্রথম হাতি শিকার করেন৷ এর আগের সময়টুকুতে তিনি রপ্ত করেছেন হাতি শিকারের পদ্ধতি। যেমন, শিকারে কোন রশির ব্যবহার কোথায় হবে, বা কিভাবে নিজের হাতেই বানাতে হবে সেই রশি, এই সব৷ তার বক্তব্যে জানা যায় – ‘যে ধরনের রশি দিয়ে গলা বাঁধা হয়, সেগুলি দিয়ে আবার পা বাঁধা হয়না। আবার ‘দুলসি’ (মাহুতের পা রাখার জায়গা) বানাতে এক প্রকার বিশের পাটের দড়ি চাই। নাহলে হাতির ঘাড়ে ক্ষত জন্মাতে পারে।’ নিজের হাতে ধরেই এসব শেখাতেন তাঁর বাবা।

পার্বতী জানান, শিকারে গেলে বেশ কয়েকদিন গভীর জঙ্গলের ভিতরেই তাদের কাটাতে হত। সেক্ষেত্রে গাছের ডালে বা কোন গাছের তলাতেই আশ্রয় নিতে হত তাদের। আত্মরক্ষার জন্য থাকত শুধু মাত্র একটি ‘মিট দা’। আর সঙ্গে একটি কড়াই, চাল ও নুন। জঙ্গলের ভিতরের নদী থেকে মাছ ধরে পুড়িয়ে নিয়েই খেতেন সকলে। দু- তিন দিন অপেক্ষার পর হাতি ধরা হলে তাকে জঙ্গলের বাইরে মেন ক্যাম্পে নিয়ে আসা হত।

সদ্য ধরা বুনো হাতিকে পোষ মানাতে শুরু হত কৌশল। প্রথম ১২- ২৪ ঘন্টা সম্পূর্ণ বাঁধা থাকত হাতিটি। আর তার চারপাশে লোকজনেরা ক্রমাগত কথা বলতে থাকতেন। কারণ হাতি বাইরের পরিবেশ ও মানুষ সম্পর্কে একদমই ওয়াকিবহাল নয়, তাই যাতে হাতিটি ধীরে ধীরে পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে পরিচিত হতে পারে, তাই এই পন্থা। এই সময় হাতি প্রচুর রেগে থাকে, খেতে দিলেও খায়না। হাতির দুই পাশে বাঁধা থাকে কুনকি। হাতিকে মেন্টাল ট্রেস থেকে মুক্ত করার জন্য জলে নামানো হয়। স্নানের পর হাতিটিকে হাঁটান হয়। এই ভাবে দিন পনেরো গেলে হাতি খানিক মানুষের বশে আসে। একপাশের একটি কুনকি খুলে দেওয়া হয় তখন। এরপর আগে, পিছে, ঘোর, দাঁড়া এই চারটি কম্যান্ড শেখান শুরু হয়। তারপর শুঁড়ে করে পিঠে মাহুতকে তোলার ট্রেনিং দেওয়া হয়। হাতিরা এতোই বুদ্ধিদৃপ্ত হয় যে মাত্র কয়েক মাসেই এই কৌশল ও পরিভাষা গুলো রপ্ত করে নেয়।

ভারত সরকারের আইন অনুযায়ী যদিও হাতি শিকার এখন নিষিদ্ধ, তবুও বিভিন্ন জায়গা থেকে হাতি খেদানি বা মাহুতের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ডাক আসে পার্বতীর। বেশ কয়েকবার অসম ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গেও তিনি এসেছেন এই কাজে৷ হাতির সঙ্গে যেন তার নাড়ির টানা, “পার্বতী পুত্র গণেশ”- এই প্রসঙ্গও তুলে তিনি হাতিকে নিজের সন্তানের সঙ্গেও তুলনা করেছেন সাক্ষাৎকারে। হাতিদের সম্পর্কে তাঁর অভিমত – “সব সময়ই ওরা থাকে আমার মনে-প্রাণে। ওদের যেমন বিশ্বাস করা যায়, মানুষকেও বোধহয় তেমন নয়।’’

You may also like

Leave a Reply!