গানে, কবিতায়, উপন্যাসে নানা ভাবে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন এবং চেতনা ফুটে উঠেছে। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক দার্শনিক-কবির রাজনৈতিক দর্শন কীরকম ছিল, সেটা তাঁর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখা থেকে অনুধাবন করা যায়।
সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করলেও রবীন্দ্রনাথ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী নেতৃবর্গকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন।
‘ঘরে বাইরে’ ও ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যথাক্রমে সন্দীপ ও ইন্দ্রনাথের সক্রিয় উগ্রপন্থী রাজনীতির বিপক্ষে ছিলেন। পক্ষান্তরে ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরার অতি সক্রিয়তাকে কবি সমর্থন করেছিলেন। আবার ‘রক্তকরবী’র রঞ্জন ও নন্দিনী, ‘মুক্তধারা’র অভিজিৎ, ‘তাসের দেশে’র রাজপুত্র এদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেম ভেঙে অর্থাৎ রাজন্যদের একনায়কতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অহিংস পথে জনগণকে একত্রিত করে সমস্ত অন্যায় নিয়মকানুন ও অচলায়তন ভেঙে সমাজবদলের জয়গান করেছেন।
তাসের দেশ’ গীতিনাট্য রবীন্দ্রনাথ অনুজপ্রতিম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। কারণ সেই সময় ভারতবর্ষে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতা ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তাসের দেশ নাটকের শুরু একটা গান দিয়ে-
‘‘তুমি কষে ধরো হাল,
আমি তুলে বাঁধি পাল…”
এই গানটার মধ্যে দিয়ে কবি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেম ভেঙে বৃহৎ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে আহ্বান করেছিলেন। গানটায় প্রকৃতির যে ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়ের কথা বলা হয়েছে, তাকে যদি ভারতবর্ষের সেই সময়ের সমাজ ধরে নেওয়া যায়, তাহলে সেই সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ ভুলে সবাইকে একত্রিত করে লড়াই করতে তিনি বলেছিলেন এবং সেই লড়াই অবশ্যই সমাজ থেকে, সিস্টেমের মাধ্যমে সিস্টেম ভাঙার লড়াই।
সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে ‘চরকা-সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল “আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ”। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ।
১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।” রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ ও ‘একলা চলো রে’ তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এবং চেতনার আরও এক উদাহরণ।
‘একলা চলো রে’ গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তাঁর অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন যুগাতিক্রমী দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছিলেন; তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দর্শনসমৃদ্ধ প্রবন্ধ, ভাষণ পড়লে এটা বোঝা যায়। এ কারণেই বাঙালির ক্ষোভ-বিক্ষোভ কিংবা বাঙালির সংকট মুক্তির পথ প্রদর্শক রূপে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতেও ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে।