সায়নী মুখার্জী
ছোট থেকে বড় উৎসবের দিন হোক বা মনখারাপ কিংবা হয়ত রাস্তায় বেরিয়েছে প্রয়োজনে,অফিস থেকে ফিরতি পথে হোক কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় যে খাবার এখন চাই ই চাই তা হল বিরিয়ানি৷ পেট আর মন দুই ভরে গেল৷ বাংলার সঙ্গে আজ বিরিয়ানির যোগ এতটাই যে বিরিয়ানিকে আজ বাঙালির আরেকপ্রকার ভাত বললেও ভুল হবে না৷ ফারসি ভাষায় বিরিঞ্জ শব্দের অর্থ চাল বা ভাত। অনেকের মতে, বিরিয়ান থেকে এসেছে যার অর্থ রোস্ট বা ভেজে নেওয়া।
ময়মনসিংহে যাকে “বিরন করা” বলা হয় তা এই ভাতকে ভাজা বোঝায়৷ মুঘল ঘরানার খাবার এই বিরিয়ানি৷ কথিত আছে বাদশা শাহজাহান এর বেগম মুমতাজ প্রজাদের সুস্বাদু অথচ পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর জন্য বিরিয়ানি বানিয়েছিলেন৷
জনশ্রুতি আছে একবার মুমতাজ মহল মুঘল সৈন্যদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যারাকে গেলেন। তাদের স্বাস্থ্যের ভগ্নদশা দেখে সম্রাজ্ঞী বাবুর্চিকে আদেশ করেন ভাত ও মাংস সহ পুষ্টিকর খাবার বানাতে৷ বার্বুচি যে খাবারটি মমতাজের কথামত তৈরি করলেন সেটাই আজকের দিনের বিরিয়ানি নামে পরিচিত। মূলত রোস্ট করা মাংস ও ভাতের সহযোগে তৈরি বিশেষ সুুস্বাদু খাবারই বিরিয়ানি। বিরিয়ানি রান্নার আগে চাল ঘি দিয়ে ভেজে নেওয়া হয়। তাই এই নামকরণ।
পোলাও ও বিরিয়ানি দুটো খাবারই সুগন্ধি চাল দিয়ে বানানো হয়, কিন্তু তফাত আছে৷ পোলাও বিরিয়ানির মূল পার্থক্য যতটা না রান্নার প্রণালীতে তার চেয়েও অনেক বেশি মশলার ব্যবহারে। বিরিয়ানির মশলায় উপাদানের বৈচিত্র্য অনেক বেশি, তুলনামূলক বেশি পরিমাণ মশলা লাগে৷ পোলাও রান্নার আগে চাল ধুয়ে কিছুক্ষণ ঘি মাখিয়ে রেখে দেওয়া হয়। তারপর জলে সিদ্ধ করা হয়৷ কিন্তু বিরিয়ানিতে চালের সুঘ্রাণ বজায় রাখতে চাল বেশি ধোওয়া হয় না। আগে থেকে ফুটিয়ে রাখা গরম জলে চাল মিনিট খানেক রেখেই তুলে নেওয়া হয়৷ তেহারীকে বিরিয়ানির রকমফের বলা যেতে পারে৷
বিরিয়ানি মূলত দুপ্রকার৷ পাক্কি ও কাচ্চি৷ পাক্কি বিরিয়ানির ক্ষেত্রে রান্না করা মাংস অর্ধেক রান্না করা চালের সঙ্গে মিশিয়ে পুরোপুরি তৈরি করা হয়৷ আর কাচ্চি বিরিয়ানিতে মাংস টকদই ও মসলা দিয়ে ম্যারিনেট করে আধসিদ্ধ চালের সঙ্গে দমে রান্না করা হয়। কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করতে অনেক বেশি সময় লাগে । একে দম বিরিয়ানিও বলা হয়৷ মাংস নরম করতে অনেকেই ম্যারিনেট করার সময় কাঁচা পেঁপে ব্যবহার করেন৷
জায়গা বিশেষে বিরিয়ানির উপকরণ নাম মশলা সবই ভিন্ন রকম৷ হায়দরাবাদি বিরিয়ানি সব থেকে মশলাদার। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানির সঙ্গে জোর টক্কর দেয় লখনউ বিরিয়ানি৷ ‘দম পুখ্ত’ পদ্ধতিতে বানানো হয়৷ চাল এবং মাংস আলাদা আলাদা ভাবে রান্না করার পর স্তরে স্তরে ভাগ করে দমে বসানো হয়। লখনউ বিরিয়ানির আদলেই কলকাতার বিরিয়ানি তৈরি করা হয়। কিন্তু লখনউ বিরিয়ানিতে শুধু জাফরান ব্যবহার করা হয়, কলকাতা বিরিয়ানিতে জাফরানের সঙ্গে কেওড়ার জল এবং আলুবোখরা ভেজানো জল ব্যবহৃত হয়। সঙ্গে আলু এবং সেদ্ধ ডিম। ভারতে একমাত্র কলকাতার বিরিয়ানিতেই ডিম দেওয়া হয়৷
ডিন্ডিগুল বিরিয়ানি তামিলনাড়ুতে স্পেশাল। সাধারণত বিরিয়ানি বাসমতি চালে রান্না করা হয়, কিন্তু এতে জিরা সাম্বা চাল ব্যবহার করা হয়। প্রচুর গোলমরিচের গুঁড়ো ব্যবহৃত হয় এবং মাংসের টুকরো ছোট ছোট টুকরো করে দেওয়া হয়।
আম্বুর বিরিয়ানি তামিলনাড়ুর আম্বুরের খাবার।। বেঙ্গালুরু-চেন্নাইতে হাইওয়ের ধারের ধাবাতে পাওয়া যায়৷ এই বিরিয়ানি মূলত চার রকমের হয়, চিকেন, মাটন, বিফ এবং চিংড়ি মাছের। এই বিরিয়ানিতে দই ব্যবহার করা হয়। মাংসকে দইয়ের মধ্যে অনেকক্ষণ রেখে তার পর তার মধ্যেই চাল দিয়ে রান্না করা হয়। পেঁয়াজের রায়তা দিয়ে পরিবেশন করা হয় এই বিরিয়ানি৷
কর্নাটকের উপকূল অঞ্চলে ভাটকল মুসলিম সম্প্রদায় ভাটকলি বিরিয়ানি বানায়৷ মশলা খুবই কম থাকে৷ মূলত পেঁয়াজ এবং কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বানানো খুবই সুস্বাদু এই বিরিয়ানি৷ কেরলের কোঝিকোর, তালাসেরি এবং মালাপ্পুরম অঞ্চলে ভীষণ জনপ্রিয় মালাবারি বিরিয়ানি।কেরলের খিমা চাল দিয়ে তৈরি হয়, এর মধ্যে কাজু, কিশমিশ ব্যবহৃত হয়। চাল আলাদা রান্না করা হয়।মাংস থাকে আলাদা। পরিবেশনের সময় ঝোল সহ পরিবেশন করা হয়৷ পাকিস্তানের সিন্ধি বিরিয়ানিতে জাফরানের বদলে কেওড়ার জল এবং মিস্টি আতর ব্যবহার করা হয়। এই বিরিয়ানিতে আলু এবং গোটা আলুবোখরা দেওয়া হয়৷